বিভুরঞ্জন সরকার
২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল যে রাজনৈতিক দলের, ২০২০ সালের ২৩ জুন সে দলটি ৭১ বছর অতিক্রম করে ৭২ বছরে পা দিল। দীর্ঘ সময়। দীর্ঘ পথপরিক্রমা। জন্মলগ্নে নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৪ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামেই দলটির পরিচিতি এবং বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এই দলের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, উদ্যোগী ছিলেন, তারা সবাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার দুই বছর না ঘুরতেই কেন একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিতে হলো, তা অবশ্যই ভাববার বিষয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার গর্ভজাত দল নয়। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরতেই এই দল গড়ে উঠেছিল। তাই এটা বলা যায় যে, জনগণের প্রয়োজনে জনগণের দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের গড়ে ও বেড়ে ওঠা।
মুসলিম লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য আওয়ামী লীগের আগেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু তখন দেশ ভাগ হয়নি। নানা কারণে মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে এই ভূখণ্ডে (বর্তমান বাংলাদেশে) জন্ম নেওয়া দল বলেও মনে করা হয় না। আওয়ামী লীগকে যেমন ‘দেশীয়’ দল মনে করা হয়, ওই দল দুটিকে তেমন নয়। তাই এখানে গড়ে-বেড়ে উঠেও ওই দুটি দল কেমন বিদেশি বা বাইরের হিসেবেই থেকে গেছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম না হয়ে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে। অবশ্য মুসলিম লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টির জনবিচ্ছিন্নতার কারণ এক নয়। মুসলিম লীগ গণবিরোধী ভূমিকা নিয়ে হারিয়ে গেছে। আর কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ মানুষের পক্ষে থেকেও তত্ত্বীয় রাজনীতির জটিলতায় গণসম্পৃক্ত হতে পারেনি।
তাই বয়সে সিনিয়র হলেও রাজনীতিতে এই দল দুটি আওয়ামী লীগকে পেছনে ফেলতে পারেনি। বরং তারা নিজেরা কেবলই পিছু হটেছে। জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে মুসলিম লীগ বয়সের ভারে এবং ভুল রাজনৈতিক পথ অনুসরণের কারণে এখন একেবারেই চলৎশক্তিহীন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিদার মুসলিম লীগ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ভূমিকা নিয়ে এক ঐতিহাসিক ভুল করে তাদের দলীয় অস্তিত্বের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। মুসলিম লীগ নামে সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল এখনো আছে, কিন্তু মানুষ তার কোনো খোঁজখবর রাখে না। মানুষের মধ্যে তার কোনো প্রভাব নেই। ইতিহাসের উপাদান না হয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়েছে মুসলিম লীগ। কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এটা ঠিক, কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছে বিদেশি প্রভাবে। ১৯১৭ সালে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মূলত তার অভিঘাতেই ভারত তথা বাংলায় কমিউনিস্ট মতবাদ এবং কমিউনিস্ট পার্টি শিকড় গাড়ে। ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন একটি সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই কমিউনিস্টদের লক্ষ্য। কমিউনিস্টরা দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী, জেল-জুলুম সহ্য করাসহ সব রকম প্রতিকূলতা মোকাবিলায় পারদর্শী হলেও কমিউনিস্ট পার্টি মূলধারার রাজনীতিতে জনপ্রিয় দল হয়ে উঠতে উঠতেও আবার হোচট খেয়ে পড়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টি প্রগতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের লক্ষ্যে রাজনীতি করে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে এক ধরনের সংযোগ গড়ে তুলে জনবিচ্ছিন্নতা কাটানোর চেষ্টা করেছিল। গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা প্রবল হয়ে ওঠায় বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি এবং প্রভাব বাড়ছিল। রুশপন্থি বলে পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মৈত্রীনীতি নিয়ে একটি কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হচ্ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছিল।
কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তারপর রাজনৈতিক মত ও পথ নিয়ে বিতর্ক এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্বের নীতি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির অবস্থা এখন ‘পথভোলা এক পথিকের’ মতো! সিপিবি আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের প্রাসঙ্গিক হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে- এটা এখন খুব কম মানুষেরই বিবেচনা বা বিশ্বাসের মধ্য আছে বলে মনে হয়।
Leave a Reply